বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ মাঈন উদ্দিনের ফিরে পাওয়া জীবনের গল্প।

স্টাফ রিপোর্টার, নরসিংদী: বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে আহত হয়ে জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে ছিলেন এক কন্যা সন্তানের পিতা ২৪ বছর বয়সী মাঈন উদ্দিন। তিনি পেশায় একজন ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালক। রিকশা চালিয়ে যে টাকা আয় করতো তা দিয়েই চলতো তাদের সংসার। ফ্যাসিস্ট স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা সরকারের পতনের দাবিতে শিক্ষার্থীদের সাথে একাত্মতা পোষণ করে নরসিংদী ইটাখোলা মোড়ে আন্দোলনে অংশ নেন । গত ১৯ জুলাই সন্ধ্যায় ইটাখোলা হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির সামনে আন্দোলনকারীদের লক্ষ্যকরে এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়ে আইন শৃঙ্খলাবাহিনী। এসময় তার হাতে ও পেটে দুটি গুলিবিদ্ধ হয়। এর একটি গুলি তার ডান হাতের একদিক দিয়ে ঢুকে অন্য দিক দিয়ে বের হয়ে যায় এবং অপর একটি গুলি তলপেটে লেগে নারী-ভুরী ভেত করে কোমরের পেছনে গুলিটি আটকে থাকে। এতে সে গুরুতর আহত হয়ে পরলে সহআন্দোলনকারী কয়েকজনের সহযোগীতায় তার পরিবার অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে তাকে রাতে প্রথমে ঢাকা পঙ্গু হাসপাতালে এবং পরবর্তীতে সেখান থেকে জরুরি ভিত্তিতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে জরুরি অপারেশনের জন্য ভর্তি করে। সে থেকে শুরু হয় তার দুর্বিষহ জীবন।
জানা গেছে, ১৯ জুলাই, গুরুতর আহত গুলিবিদ্ধ মাইন উদ্দীনকে রাত ১১ টায় জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতালে নেওয়া হয় এবং ঐ রাতেই অর্থোপেডিক হাসপাতাল থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে জরুরি ভিত্তিতে প্রেরণ করা হয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মাঈন উদ্দিনের একটি জরুরী অপারেশন করানো হয়। গুলিবিদ্ধ মাইন উদ্দীনের পেটে গুলির ফলে তার পেটের খাদ্যনালী বেশ কয়েক জায়গায় ফুটো হয়ে যায়। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ফলে সে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে উপনীত হয়। সে সময় তার পেটের খাদ্যনালীর বেশ কিছু অংশ কেটে রিকনস্ট্রাকটিভ সার্জারির মাধ্যমে পেটের ডানপাশে মল ত্যাগ করার জন্য কোলোস্টমি ব্যাগ স্থাপন করা হয়। যার ফলশ্রুতিতে পরবর্তীতে স্বাভাবিক যে মলত্যাগের প্রক্রিয়া তা কোলোস্টোমি ব্যাগের মাধ্যমে করানো হতো।
বেশ কিছুদিন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকার পর ছাড়পত্র নিয়ে নরসিংদীর শিবপুর উপজেলার বাড়ৈআলগী গ্রামে তার বাড়ীতে ফিরে আসে। পরবর্তীতে তার পেটে আবার যখন ব্যথা শুরু হয় এবং অসুস্থতা বোধ করে, তখন তাকে পুনরায় ১২ আগস্ট নরসিংদী জেলা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে সে ৬ দিন চিকিৎসা নেয়ার পর উন্নত চিকিৎসার জন্য পূনরায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়।
নরসিংদী জেলা হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. এ এন এম মিজানুর রহমান জানান, জেলা হাসপাতালে ভর্তির সময় তার দুর্বিষহ জীবন আমাদের চোখে পড়ে। তার পেটে ব্যথা, শারীরিক-মানসিক ও সামাজিক যে কষ্ট সেগুলো চিকিৎসকদের মনে হৃদয়বিদারকতা ও স্পর্শকাতরতার সৃষ্টি করেছে। মাত্র ২৪ বছর বয়সের এই তরুণ প্রতিনিয়তই তার ভবিষ্যত জীবন সম্পর্কে হতাশা প্রকাশ করতো আমাদের সামনে।
পরবর্তীতে আমরা মাননীয় স্বাস্থ্য উপদেষ্টা জনাব নূরজাহান বেগম এবং ডা. মাহমুদুল হাসান, তাঁর ব্যক্তিগত কর্মকর্তা ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একজন সমন্বয়ক, ওনাদের সাথে মাঈন উদ্দিনের উন্নত চিকিৎসার ব্যাপারে যোগাযোগ করি। পরবর্তীতে ওনারা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডিরেক্টর ব্রিগ্রেডিয়ার জেনারেল আসাদুজ্জামান স্যারকে অবগত করেন। আমি আসাদুজ্জামান স্যারের সাথে যোগাযোগ করে এবং প্রফেসর সালমা সুলতানা ম্যাডামের অধীনে তাকে ভর্তি করা হয়। পরবর্তীতে সেখান থেকে বিজিবি হাসপাতালে তাকে নেয়া হয়, সেখান থেকে আবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়।
গত ২৩ অক্টোবর তার রিকন্সট্রাক্টিভ সার্জারির মাধ্যমে রিভার্সেল অব এন্ড-জেজোনস্টোমি ও কোলেস্টেমি ক্লোজার করা হয়। এর ফলশ্রুতিতে সে এখন স্বাভাবিক নিয়মে মল ত্যাগ করতে পারছে।
আমরা মনে করি, তার জীবনের যে কষ্ট ছিল, যেমন- খাবার খাওয়ার একটু পরেই সে তার কোলস্টোমি ব্যাগ খুলে মল পরিষ্কার করা থেকে শুরু করে তার যে দুর্বিষহ জীবন, শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক যে কষ্ট ছিল সেটা অনেকশাংশে দূর হয়েছে। তবে এখন সে কিছুটা শারীরিকভাবে দুর্বল থাকলেও মানসিকভাবে তাকে পুরোপুরি সুস্থ রাখার চেষ্টা করছি আমরা।
আমি যেটা মনে করছি, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অসুস্থ গুলিবিদ্ধ একজন মাঈন উদ্দিন, জীবনমৃত অবস্থায় বেঁচে ছিল। ২৪ বছরের একটি ছেলের যখন তার খাদ্যনালী কেটে কোলোস্টমি করা হয় এবং সে তার নিজের চোখে তার মল ত্যাগ করা দেখা এবং সে তার ব্যাগ পরিষ্কার করা প্রতিদিন দেখে, সে যে মানসিক চাপ বয়ে বেড়াচ্ছিলো, নরসিংদী জেলা হাসপাতাল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সর্বোপরি স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয়ের মাননীয় স্বাস্থ্য উপদেষ্টা জনাব নূরজাহান বেগমসহ সকল চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী ও ছাত্র সমন্বয়কদের আন্তরিক সহযোগিতায় একজন মাঈন উদ্দিন তার নতুন জীবন ফিরে পেয়েছে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একজন আহত অথবা জীবনমৃত একজন রোগীকে আমরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার জন্য যতটুকু চেষ্টা করতে পেরেছি, আমরা তার এই চিকিৎসার সাথে সম্পৃক্ত থাকতে পেরে নিজেদেরকে ভাগ্যবান মনে করছি এবং সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহর নিকট অশেষ কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। সুস্থ হওয়ার পরে আহত মাঈন উদ্দিন তার চার বছরের সন্তানসহ সপরিবারে নরসিংদী জেলা হাসপাতালে আমাদের সাথে যখন দেখা করতে আসে চিকিৎসক হিসেবে এ আনন্দঘন অনুভূতি আমাদের হৃদয়কে স্পর্শ করে।
তিনি আরো বলেন, মাঈন উদ্দিন বর্তমানে সুস্থ, কিন্তু আগের মত ভারি কাজ করতে পারবে না। তাকে সারা জীবনই কিছু নিয়ম কানুনের মধ্যে থাকতে হবে। তার জীবন যাপনটা একটা নির্দিষ্ট নিয়মের মধ্যে থেকে এবং প্রতিনিয়ত তাকে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে চলতে হবে। তাকেও তার জীবন সম্পর্কে একটু সচেতন হয়ে চলতে হবে।
এ প্রসঙ্গে মাঈন উদ্দিনের কাছে জানতে চাইলে আহত মাঈন উদ্দিন বলেন, হাসপাতালে আহত অবস্থায় দুর্বিষহ জীবন যাপনকালে জেলা হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডাঃ মিজান স্যারের তত্ত্বাবধানে; স্বাস্থ্য উপদেষ্টা ও ঢাকা মেডিকেল কলেজের চিকিৎসকদের সার্বিক সহযোগিতায় আমি নতুন জীবন ফিরে পেয়েছি। আমি কখনো চিন্তাও করিনি যে আমি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারবো। আমি এখন যেহেতু ভারি কাজ করতে পারবো না, আমাকে কোনো চাকরি বা কাজের ব্যবস্থা করে দিলে, ভবিষ্যতে আমি তার মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে পরিবার নিয়ে কোনভাবে চলতে পারি, এটি সরকারের কাছে আমার আকুল আবেদন।