নরসিংদীর বেলাবতে সিটিসেল টাওয়ারে হরিলুট নেপথ্যে প্রভাবশালী মহল

নিজস্ব প্রতিবেদকঃ নরসিংদীর বেলাবতে দেশের প্রথম মোবাইল ফোন কোম্পানি সিটিসেল’র পরিত্যক্ত টাওয়ার থেকে কয়েক কোটি টাকা মূল্যের মালামাল হরিলুট করে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ উঠেছে উপজেলা চেয়ারম্যান শমসের জামান ভূঁইয়া লিটন ও উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি সারোয়ার হোসেন অপুর বিরুদ্ধে।
কোন রকম টেন্ডার ছাড়াই নিজেদের পদ-পদবী এবং দলীয় প্রভাব খাটিয়ে টাওয়ারের বিভিন্ন মূল্যবান সরঞ্জাম ও বিটিএস রুমের মালপত্র খুলে নেয়ার পাশাপাশি মূল টাওয়ার ভেঙ্গে নেওয়ার অভিযোগ করেন এলাকাবাসী।
রমজান মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে ঈদ পরবর্তী ২০/২৫ দিন ধরে উপজেলার নারায়ণপুর ইউনিয়নের খামারেরচর এলাকায় সিটিসেল কোম্পানির নিজস্ব সম্পত্তির উপর নির্মিত পরিত্যক্ত সিটিসেল টাওয়ারে এ হরিলুটের ঘটনা ঘটে।
জানা যায়, দেশের প্রথম মোবাইল ফোন কোম্পানি সিটিসেল ২০১৪ সালে বন্ধ হয়ে গেলে সারাদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সিটিসেলের টাওয়ারগুলো পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকে।
এই সুযোগে দলীয় প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি বেলাব উপজেলার খামারেরচর এলাকার সিটিসেল টাওয়ারের কয়েক কোটি টাকার মালামাল হরিলুট করে নিয়ে যায়।
সিটিসেল টাওয়ারের মালপত্র খুলে নিচ্ছে এমন সংবাদের ভিত্তিতে বুধবার (১৭ মে) নরসিংদী জেলা রিপোর্টার্স ক্লাবের সভাপতি (ভারপ্রাপ্ত) শফিকুল ইসলাম রিপন ও সাধারণ সম্পাদক মনিরুজ্জামান মনির’র নেতৃত্বে ক্লাবের একটি টিম বেলাব উপজেলার খামারচর এলাকায় যায়। সরেজমিন গিয়ে দেখা যায় টাওয়ারের প্রধান ফটক সীলগালা করা থাকলেও ভিতরে বিটিএস রুমের দুটি দরজাই খোলা । বাহির থেকে যতটুকু দেখা যায় তাতে মনে হয়েছে রুমের ভিতরে তেমন কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। রুমের ভেতরের সকল মালামাল হরিলুটের পর এখন চলছে মূল টাওয়ার ভাঙ্গার কাজ। ইতোমধ্যেই মূল টাওয়ারের উপরের অংশ ভেঙে মালামাল সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। কথা বলার জন্য টাওয়ার ভাঙ্গার কাজে নিয়োজিত শ্রমিকদের বাসায় গিয়ে কাউকেই পাওয়া যায়নি। সাংবাদিকদের উপস্থিতির বিষয়টি টের পেয়ে তারা রান্না করা গরম ভাত তরকারি রেখেই পালিয়ে যায়।
এসময় স্থানীয়রা জানান , আনুমানিক ১৯/২০ রোজার দিকে বেলাব উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান শমসের জামান ভূঁইয়া লিটন, নারায়ণপুর ইউপি চেয়ারম্যান কাজল, উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি সারোয়ার হোসেন অপু গাড়ি নিয়ে টাওয়ারের সামনে এসে সিকিউরিটি সুপারভাইজার সিরাজুল ইসলামকে ডেকে পাঠায়। এসময় উপজেলা চেয়ারম্যান লিটন সিরাজুল ইসলামকে পরিত্যক্ত সিটিসেল টাওয়ারটি নিলাম হয়েছে বলে জানায়। এতে বৃদ্ধ সিরাজুল ইসলাম নিলামের কাগজ দেখতে চাইলে উপজেলা চেয়ারম্যানের নিজের ও আরজু নামে অপর এক ব্যক্তির স্বাক্ষরযুক্ত একটি নিলামের কাগজ তাকে বের করে দেখান। নিলামের ওই কাগজে সিটিসেল কোম্পানির কারো স্বাক্ষর না থাকায় সন্ধিহান হয়ে সিরাজুল ইসলাম উপজেলা চেয়ারম্যানকে সিটিসেল কোম্পানির কারো স্বাক্ষর বা ইউএনও’র স্বাক্ষর করিয়ে আনতে বলেন বলে জানায় স্থানীয়রা।
তারা আরও জানায় ঠিক ওই সময়ে উপজেলা চেয়ারম্যান শমসের জামান ভূঁইয়া লিটন ও নারায়ণপুর ইউপি চেয়ারম্যান কাজলের উপস্থিতিতে ছাত্রলীগের সভাপতি সারোয়ার হোসেন অপু টাওয়ারের প্রধান ফটকসহ বিটিএস রুমের তালা জোর পূর্বক ভেঙ্গে ফেলে এবং টাওয়ার ভাঙ্গার কাজে নিযুক্ত কথিত ঠিকাদার আরজু মিয়ার সহযোগিতায় বিটিএস রুমের বিভিন্ন মূল্যবান যন্ত্রাংশ খুলে নেয়। এভাবে বেশ কয়েকদিন হরিলুট চলতে থাকে। এলাকাবাসী ও টাওয়ারের সিকিউরিটি সিরাজুল ইসলামসহ তার তিন সহকর্মী তাদেরকে বাধা দিলেও তারা তা মানেননি।পরে সিকিউরিটি ইনচার্জ সিরাজুল ইসলাম থানায় একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করলেও থানা থেকে কোন ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। এদিকে টাওয়ার ভাঙ্গার খবরটি পল্লীবিদ্যুৎ অফিস জানতে পেরে তারা তাদের বকেয়া অর্থ আদায়ের স্বার্থে এসে বাধা দেয়। এরপরেও টাওয়ার ভাঙ্গার কাজ চালিয়ে যেতে থাকে প্রভাবশালী মহলটি।
পরবর্তীতে পল্লীবিদ্যুৎ বেলাব উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর আবেদন করলে উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট মোহাম্মদ নাজমুল হাসান এসে টাওয়ারের প্রধান ফটকে সীলগালা করে দিয়ে যায়। ততক্ষনে দাঁড়ানো টাওয়ারের লোহার পাতগুলো ছাড়া বাকী সব খুলে লুট করে সাবাড় করে ফেলে স্থানীয় ওই প্রভাবশালী মহল।
এব্যাপারে সিকিউরিটি সুপারভাইজর সিরাজুল ইসলাম বললে, আমি টাওয়ার ভাঙ্গা ঠেকাতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছি। এব্যাপারে থানায় একটি লিখিত অভিযোগ করেছিলাম। কিন্তু প্রশাসন তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়নি। উল্টো উপজেলা চেয়ারম্যান আমাকে অভিযোগটি তুলে নেয়ার জন্য ডেকে নিয়ে শাসালে বাধ্য হয়ে আমাকে তা তুলে নিতে হয়েছে।
ঠিকাদার আরজু মিয়াকে ফোন করে এবিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ জানেনিতো এটার সাথে উপজেলা চেয়ারম্যান, উপজেলা ছাত্রলীগ সভাপতি ও স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান সহ উপজেলার অন্যান্য নেতারা জড়িত। তাদের নির্দেশেই এটা ভাঙ্গা হচ্ছে। এখন টাওয়ারটি সীলগালা হয়ে গেছে প্রশাসনকে ম্যানেজ করে পুনরায় ভাঙ্গার কাজ শুরু হবে বলে জানান তিনি।
টাওয়ার ভাঙ্গার হোতা উপজেলা ছাত্রলীগ সভাপতি সারোয়ার হোসেন অপু বলেন, এ ঘটনার সাথে আমি জড়িত নই। যারা আমার কথা বলেছেন তারা মিথ্যাচার করেছেন। ‘আসলে এই টাওয়ার ভাঙ্গার পিছনে ইন্ধন জুগিয়েছে ওই বৃদ্ধ সিকিউরিটি গার্ড সিরাজ। তিনি ব্যক্তিগত সুবিধা আদায়ের জন্য যারা টাওয়ারটা ভেঙ্গেছে তাদেরকে সুযোগ করে দিয়েছেন।
নারায়ণপুর ইউপি চেয়ারম্যান কাজল বলেন, টাওয়ার ভাঙ্গার বিষয়টি আমি জানতাম না। উপজেলা চেয়ারম্যান লিটন ভাই টাওয়ার এলাকায় এসে আমাকে ফোন করলে আমি সেখানে আসি। তবে তিনি নিলামের যে কাগজ দেখিয়েছেন তা আমার কাছে সঠিক মনে না হওয়ায় আমি নিলামের সঠিক কাগজ এনে টাওয়ার ভাঙ্গতে বলি তাদের। পরবর্তীতে তারা কোন ধরনের কাগজ পত্র না দেখিয়েই টাওয়ার ভাঙ্গার কাজ চালিয়ে যায় তাই আমি আর এবিষয়ে কোন খোঁজখবর নেইনি।’
আবদুল্লাহ নামে সিটিসেল কোম্পানির একজন কর্মকর্তা বলেন, এভাবে অন্যের জিনিস ভেঙ্গে নিয়ে যাওয়াটা অন্যায়। টাওয়ার নিলামের নামে তারা যে কাগজ দেখিছে তা সম্পূর্ণ বানোয়াট ও ভিত্তিহীন। সিটিসেল কোম্পানি টাওয়ার ভাঙ্গা সংক্রান্ত কোন নিলাম দেওয়াতো দূরের কথা নিলাম আহ্বানই করেনি।
ভূয়া কাগজ সৃজন করে জালিয়াতি করেছে টাওয়ার ভাঙ্গার সাথে জড়িতরা। আসলে আমাদের টেন্ডারের পদ্ধতিটাই আলাদা। আর যদি নিলাম হয়েই থাকে তাহলে তাতে আমাদের কোম্পানির স্বাক্ষর ও সীল থাকবেনা? এটা কি করে হয়। আপনারা সেটা দেখেছেন কিনা জানিনা সেখানে শুধু উপজেলা চেয়ারম্যান আর ঠিকাদার আরজুর স্বাক্ষর আছে। এ বিষয়ে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে বলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন বলে ও জানান তিনি ।
টাওয়ার ভাঙ্গার মূল হোতা বেলাবো উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান শমসের জামান ভূঁইয়া লিটনের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, আমি ঘটনার প্রথম দিন রমজান মাসে সেখানে গিয়েছিলাম এরপর আর এই বিষয়ে কোন কিছুই জানিনা। এলাকার মানুষ আইস্যা ধরছে তাই সেদিন গেছিলাম। তবে শুনছি সেটা নাকি সীলগালা হয়ে গেছে। নিলামের কাগজে তার স্বাক্ষরের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি কোন সদুত্তর দিতে পারেননি।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আয়েশা জান্নাত তাহেরা বলেন, এব্যাপারে সিটিসেল কোম্পানির কোন অথরিটি আমার কাছে কোন অভিযোগ করেনি বা তাদের কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়নি।বকেয়া বিলের জন্য পল্লীবিদ্যুৎ থেকে আবেদন করা হলে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে টাওয়ারের প্রধান ফটকে তালা মেরে দেওয়া হয়। তবে এই ভাঙচুর বা লুটপাটের ঘটনায় কারা জড়িত তাদের সম্পর্কে কিছুই জানা নেই বলে ও জানান তিনি।
বেলাব থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তানভীর আহমেদ’র কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, থানায় অভিযোগের পর কাজ বন্ধ ছিল। পরে কার্যাদেশ পাওয়ার পর অভিযোগ তুলে নিয়েছে। অভিযোগকারী এমনটাই জানিয়েছিল বলেও জানান তিনি।