একাত্তরের আগুনঝরা মার্চ

বাংলার ইতিহাসে একাত্তর এসেছিল অগ্নিশিখা হয়ে। বীর বাঙালি অস্ত্র হাতে আঘাতে আঘাতে চূর্ণ করেছে শত্রুর দুর্গ, বাধ্য করেছে ৯৩ হাজার পাকিস্তানি বর্বরকে মাথা নত করে আত্মসমর্পণে। টেনে দিয়েছে দুই যুগের অসহনীয় শোষণ ও অবর্ণনীয় যন্ত্রণার সমাপ্তিরেখা। এই আগুনঝরা একাত্তরে মার্চ এসেছিল বাঙালির শেষ যুদ্ধের পথে অভিযাত্রার আলোকবর্তিকা হয়ে। মার্চের ঘটনাপ্রবাহ ছিল দ্রুত পরিবর্তনশীল ও বৈচিত্র্যময়।
পাকিস্তানের সঙ্গে ২৩ বছরের অশুভ তথাকথিত ভ্রাতৃত্বের গাঁটছড়ার রূপকথা একাত্তরের মার্চ মাসে এসে থমকে দাঁড়িয়ে যায় এক পরিবর্তনের সন্ধিক্ষণে। তথাকথিত ইসলামী ভ্রাতৃত্ববোধের মুখোশের অন্তরালে পাকিস্তানি সামরিক ও সামন্ততন্ত্রের দুই যুগের অসহনীয় শোষণের জাঁতাকলে আবদ্ধ বাঙালি ও বর্বর পাকিস্তানিরা একাত্তরের মার্চে এসে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যায় সমানাধিকার, স্বাধিকার, স্বাধীনতা ও শোষণের পরিসমাপ্তির প্রশ্নে। পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী হয়েও বাঙালিরা কোনোদিন পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের ক্ষমতার বা সম্পদের সমান অংশীদার হতে পারেনি। সেই প্রেক্ষাপটে একাত্তরের মার্চে যখন ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রশ্নটি বাস্তবতার সম্মুখীন হলো, তখন পাকিস্তানিদের ভ্রাতৃত্ববোধের সংজ্ঞা আগের সব বছরের মতোই কুৎসিতভাবে প্রকাশিত হলো। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী কর্তৃক নির্বাচিত, পার্লামেন্টে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতাপ্রাপ্ত বাঙালির দল আওয়ামী লীগ ও নেতা শেখ মুজিবকে ক্ষমতা হস্তান্তরে পাকিস্তানি সামরিক স্বৈরতন্ত্র নানা টালবাহানা সৃষ্টি করে যেতে থাকে।
উল্লেখ্য, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে আত্মপ্রকাশে পাকিস্তানি স্বৈরতন্ত্র ও রাজনৈতিক নেতারা হতবিহ্বল হয়ে পড়ে। আওয়ামী লীগের ১৬৭ আসনের বিপরীতে ৩১৩ আসনের পার্লামেন্টে পশ্চিম পাকিস্তানের সবচেয়ে জনপ্রিয় দল ভুট্টোর পিপলস পার্টি পায় মাত্র ৮১টি আসন। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের ফলে বিজয়ী দলের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরই ছিল নিয়মতান্ত্রিক গণতান্ত্রিক পদ্ধতি পুনঃপ্রতিষ্ঠার একমাত্র পথ। ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানের ক্ষমতা দখল করার পর এই অঙ্গীকার করে আসছিল ধারাবাহিকভাবে, যেমনটি করেছিল বন্দুকের নল ঠেকিয়ে ও প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলকারী তার পূর্বসূরিরা। কিন্তু পাকিস্তানের ইতিহাসে কখনোই বাঙালিকে ক্ষমতার মসনদে অধিষ্ঠিত হতে দেয়া হয়নি বা দিলেও তা নানা উছিলায় কেড়ে নেয়া হয়েছে। এমনকি ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজয়ের পরও পাকিস্তানি স্বৈরশাসন প্রাদেশিক পরিষদেও বাংলার মানুষের ক্ষমতাগ্রহণ সহ্য করতে পারেনি। তাই ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের পর গঠিত যুক্তফ্রন্ট সরকারকে মাত্র দেড় মাসের মধ্যে অপসারণ করা হয় ও পূর্ববঙ্গে গভর্নরের শাসন চালু করা হয়।
১৯৫৪ সালের মতোই ১৯৭০ সালেও ব্যালটে পরাজিত পাকিস্তানি শাসকরা প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করে যেতে থাকে। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটানোর ছক কষে ভুট্টোর সঙ্গে আলোচনা করে ইয়াহিয়া মার্চের ১ তারিখে ৩ মার্চ অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় পরিষদ অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করে। ইয়াহিয়া-ভুট্টো চক্র এ সাধারণ বিষয়টি অনুধাবনে ব্যর্থ হয় যে পঞ্চাশের দশকের পূর্ববাংলা তত দিনে পরিণত হয়েছে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে একটি সুসংগঠিত জাতীয়তাবাদী চেতনাসমৃদ্ধ শক্তিতে, যার অগ্রভাগে রয়েছে প্রজ্ঞাবান, দূরদর্শী ও পঞ্চাশের দশকের তুলনায় আরও অনেক বেশি সাহসী, আধুনিক ও আপোসহীন নেতৃত্ব। বাঙালির হাতে তখন প্রস্তুত মুক্তির সনদ ছয়দফা, যা পুরোপুরি বাস্তবায়নে বঙ্গবন্ধু ছিলেন জাতির কাছে অঙ্গীকারবদ্ধ। আর বাঙালির এই নেতা তার অঙ্গীকার থেকে কখনো বিচ্যুত হননি। বস্তুত নির্বাচনে জয়লাভ করার পর থেকেই আওয়ামী লীগ ৬ দফাভিত্তিক সংবিধান প্রণয়নে সর্বশক্তি নিয়োগ করে ও ১৯৭১-এর ফেব্রুয়ারি মাসেই একটি খসড়া শাসনতন্ত্র ইয়াহিয়াকে পাঠিয়ে দেয়, যা নিয়ে ইয়াহিয়া ভুট্টোর সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করে ও যার পরিপ্রেক্ষিতেই ইয়াহিয়া-ভুট্টোর যৌথ সিদ্ধান্তে জাতীয় পরিষদ অধিবেশন পিছিয়ে দেয়া হয়। এটা ছিল দেশের একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানিদের চরমতম অবজ্ঞা ও ধৃষ্টতার বহিঃপ্রকাশ ও বাংলার জনগণের সঙ্গে তাদের চরমতম বিশ্বাসঘাতকতার নামান্তর।
নির্বাচনের ফল প্রকাশের পর অনতিবিলম্বে, একাত্তরের ১২ জানুয়ারি ইয়াহিয়া বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনার জন্য ও বিজয়ী নেতার মনোভাব বোঝার জন্য ঢাকা আসেন। বঙ্গবন্ধু তাকে বাংলার মানুষের প্রাণের দাবি ৬ দফার কথা স্মরণ করিয়ে দেন। বাহ্যিকভাবে ইয়াহিয়া বিষয়টি মেনে নেয়ার ভান করেন ও দুই দিনের আলোচনা শেষে পশ্চিম পাকিস্তানে যাত্রার প্রাক্কালে বিমানবন্দরে সংবাদমাধ্যমের কাছে শেখ মুজিবকে পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে উল্লেখ করেন। আলোচনার টেবিলে বঙ্গবন্ধুকে জানানো হয় যে অতি শিগগিরই প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করবেন। কিন্তু ইয়াহিয়া বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনা শেষে পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরেই অতি দ্রুততার সঙ্গে ভুট্টো ও সামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের সার্বিক পরিস্থিতি, বিশেষত বঙ্গবন্ধুর ৬ দফার বিষয়ে অনমনীয়তা নিয়ে আলোচনায় বসেন ও পরবর্তী কার্যক্রম নির্ধারণ করেন।
ক্ষমতালিপ্সু ভুট্টো ভালোভাবেই জানতন যে বঙ্গবন্ধু কখনোই বাংলার মানুষের প্রাণের দাবির বিষয়ে কোনো প্রকার আপোসকামিতায় লিপ্ত হবেন না। ফলে, প্ল্যান বি অনুযায়ী ২৫ মার্চের নারকীয় গণহত্যা এবং এর ধারাবাহিকতা ও বঙ্গবন্ধুকে বন্দি করে বিচারের জন্য পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যায়া ছিল বাঙালিকে চিরতরে স্তব্ধ করে দেয়ার নির্মম কৌশল। আর সেই সুবাদে বঙ্গবন্ধুবিহীন ও আওয়ামী লীগবিহীন পার্লামেন্টে ভুট্টোর ক্ষমতার মসনদে আহরণ ছিল সময়ের ব্যাপার মাত্র। কিন্তু তত দিনে বাংলার মানুষকে মুজিব যে মুক্তির মন্ত্রে উজ্জীবিত করেছেন সেই আকাঙ্ক্ষা থেকে এ দেশের মানুষকে নিবৃত্ত করা ছিল অসম্ভব। তাই মুক্তির মন্ত্রে দীক্ষিত বাঙালি অস্ত্র হাতে রুখে দিয়েছে সব আগ্রাসন। ছিনিয়ে এনেছে স্বাধীনতার রক্তিম সূর্যকে।
ভুট্টো জানুয়ারি মাসের ২৭ তারিখে ঢাকায় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তিন দিনব্যাপী আলোচনা করেন ও পরিশেষে ক্ষমতা ভাগাভাগি করার প্রস্তাব দেন, যা বঙ্গবন্ধু সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেন। মুজিব-ভুট্টো ঢাকা বৈঠকের অব্যবহিত পরই ইয়াহিয়া মার্চের ৩ তারিখে পার্লামেন্টের অধিবেশন আহ্বান করেন। কিন্তু ভুট্টো ফেব্রুয়ারির ১৫ তারিখে ঘোষণা করেন যে, শেখ মুজিব ৬ দফার বিষয়ে নমনীয় না হলে তিনি ও তার দল অধিবেশনে যোগদান করবেন না। অন্যকোনো দল অধিবেশনে গেলে তিনি তাদের হত্যা করাসহ বিবিধভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলার হুমকি দেন। এভাবেই আগুনঝরা মার্চের পটভূমি রচিত হতে থাকে।
নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠপ্রাপ্ত দলের নেতা শেখ মুজিবের সঙ্গে আলোচনা না করে ভুট্টোর সঙ্গে ষড়যন্ত্রমূলক শলা-পরামর্শ করে ইয়াহিয়া ১ মার্চ পার্লামেন্টের ৩ মার্চ অনুষ্ঠিতব্য পর্লামেন্ট অধিবেশন অনির্দিষ্ট কালের জন্য স্থগিত করেন। এ ঘোষণা সারা বাংলায় দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ল। সব স্তরের মানুষ নেমে আসে ঢাকাসহ বাংলার সব শহর-নগরের রাস্তায়। এমনকি বাংলার শান্ত গ্রামগুলোও যেন পরিণত হয় তপ্ত অঙ্গারে। ‘জয় বাংলা’, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’, ‘তোমার আমার ঠিকানা: পদ্মা-মেঘনা-যমুনা’, ’তোমার নেতা, আমার নেতা: শেখ মুজিব শেখ মুজিব’- স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে সারা বাংলার পথ-ঘাট। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলা থেকে বিক্ষোভ মিছিল হোটেল পূর্বাণীতে বঙ্গবন্ধুর কাছে যায়। সেখানে পাকিস্তানের পতাকা ও জিন্নাহর প্রতিকৃতি পোড়ানো হয়।
বঙ্গবন্ধু তাৎক্ষণিকভাবে সংবাদ সম্মেলন করে ইয়াহিয়ার ঘোষণার প্রতিবাদ জানান ও জনতাকে শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন করে যাওয়ার আহ্বান জানান। সেদিন বঙ্গবন্ধু সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে দেশের মানুষকে এই পাকিস্তানি ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান, সেই সঙ্গে তিনি তাৎক্ষণিকভাবে ৬ দিনের কর্মসূচি দেন, যার মধ্যে ছিল ২রা মার্চ ঢাকায় পূর্ণ হরতাল ও পরদিন দেশব্যাপী হরতাল। তিনি তাৎক্ষণিকভাবে ঘোষণা দেন ৭ মার্চের রেসকোর্স ময়দানের জনসভার, যেখানে তিনি পরবর্তী কর্মসূচি দেবেন বলে জানান। ছাত্র-জনতা সেদিনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হল ও জিন্নাহ হলের নাম পরিবর্তন করে যথাক্রমে সার্জেন্ট জহুরুল হক হল ও সূর্যসেন হল নামকরণ করে। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে প্রতিষ্ঠিত হয় স্বাধীন বাংলা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ।
সেদিন জনতা সেনা টহল ও কারফিউয়ের কোনো তোয়াক্কা না করে নগরীর সব রাজপথ প্লাবিত করে বন্যার স্রোতধারার মতো মিছিল করে বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বরের বাসস্থান ও বিশ্ববিদ্যালয় অভিমুখে ধাবিত হতে থাকে। ২ মার্চ পাকিস্তানিদের গুলিবর্ষণে বহু লোক হতাহত হয়। বঙ্গবন্ধু এর প্রতিবাদে অনির্দিষ্টকালের জন্য অসহযোগ আন্দোলন ঘোষণা করেন। বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাসভবন হয়ে ওঠে সব রাজনৈতিক ও সরকারি কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু। অসহযোগ আন্দোলনের ফলে পাকিস্তানিদের কর্মকাণ্ড সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে কেবল সেনা ছাউনিভিত্তিক। রেডিও, টেলিভিশন, পত্রিকা, অফিস-আদালত, কালেক্টরিয়েটসমূহ, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, এমনকি পুলিশ বাহিনীও অসহযোগ আন্দোলনে সাড়া দেয়। ফলে পূর্ব পাকিস্তানে বেসামরিক প্রশাসন, ব্যাংক, বিমা, রেল, বিমান, পোস্টাল সার্ভিসসহ সবকিছু স্থবির হয়ে পড়ে। ইয়াহিয়া খান ‘বেলুচিস্তানের কসাই’ টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দেন। কিন্তু হাইকোর্ট বঙ্গবন্ধুর অসহযোগ আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে টিক্কা খানকে শপথ গ্রহণ করানো থেকে বিরত থাকে। এই পরিস্থিতিতে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতিকে ঢাকায় নিয়ে আসতে হয় টিক্কা খানকে শপথ গ্রহণ করানোর জন্য। বিষয়টির গুরুত্ব এখানেই যে, বঙ্গবন্ধু ঘোষিত অসহযোগ আন্দোলনের ব্যাপকতা এতখানিই ছিল যে, সর্বোচ্চ আদালতও এর সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছিল। সারা পূর্ব পাকিস্তানের শাসনব্যবস্থা পরিচালিত হতে থাকে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনামাফিক। বৃটিশ-ভারতে মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনের চেয়েও এই আন্দোলনের কর্মকাণ্ডভিত্তিক পরিসর ছিল ব্যাপক। এর বাস্তব প্রভাবও ছিল সুদূরপ্রসারী। প্রকৃতপক্ষে এ ধরনের ব্যাপক গণসমর্থনপুষ্ট আন্দোলন একমাত্র ১৯১৭ সালের রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ছাড়া আর কোনো আন্দোলনের ছিল বলে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় না।
পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ৩ মার্চ শোকদিবস হিসেবে পালিত হয় পকিস্তানি বর্বরদের গুলিতে শহীদ বীরদের স্মরণে। এদিন বঙ্গবন্ধুর বাসভবন আগের মতোই সব রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র হয়ে রইল। বঙ্গবন্ধু মার্চের শুরু থেকেই, অর্থাৎ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন পিছিয়ে দেয়ার দিন থেকেই মোটামুটি বুঝতে পেরেছিলেন সেই অমোঘ সত্যটি যে, শান্তিপূর্ণ পন্থায় ক্ষমতা হস্তান্তর হওয়ার কোনো সম্ভাবনা আর নেই। পাকিস্তানিরা বাঙালিদের পাকিস্তানের নেতৃত্ব প্রদান কখনোই করবে না। এ জন্য প্রয়োজনে তাকে হত্যা করতেও ওরা দ্বিধাবোধ করবে না। এমন ধারণায় তখন থেকেই তিনি চলমান সংগ্রামকে আরও এগিয়ে নিয়ে দেশকে স্বাধীন করার জন্য নেতৃত্বের ধারাবাহিকতা সৃষ্টি করে যান। তিনি মার্চের ৩ তারিখে ঘোষণা করেন যে বাঙালির স্বাধীনতার সংগ্রাম যেন তার অবর্তমানে থেমে না থাকে। তিনি ছাত্রলীগ ও শ্রমিক লীগের যৌথ সভায় এদিন ঘোষণা করেন যে, তিনি না থাকলেও তার সহকর্মীরা যেন এই সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে বাংলাদেশকে স্বাধীনতার পথে ধাবিত করেন। তিনি বলেন যে, এক নেতৃত্বকে হত্যা করলে যেন পরবর্তী নেতৃত্ব সামনে চলে আসে দেশকে স্বাধীনতার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দেয়ার জন্য। যেকোনো মূল্যে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যেতে তিনি রাজনীতিবিদ, ছাত্র-জনতা, সবাইকে আহ্বান জানান।
অপরদিকে পাকিস্তানিরা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের আন্দোলনকে দমানোর জন্য সাগর ও আকাশপথে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সেনা ও অস্ত্র আমদানি করে সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করতে থাকে। এমভি সোয়াত নামক জাহাজ ঠিক সে সময়ই অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে নোঙর করে। এ খবর বন্দরের শ্রমিক মারফত প্রকাশিত হওয়ার পর হাজার হাজার মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে বন্দর ঘেরাও করে ও পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে সংঘাতে লিপ্ত হয়। চট্টগ্রামের ইপিআর বাহিনী, যার কমান্ডিং অফিসার হিসেবে তখন দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন ক্যাপ্টেন রফিক (পরে মেজর, সেক্টর কমান্ডার ও বীরোত্তম), প্রতিবাদরত জনতার ওপর গুলিবর্ষণ করতে অস্বীকার করেন। ক্যাপ্টেন রফিক পরবর্তীকালে চট্টগ্রামে সার্বিক যুদ্ধের সূচনা করেন। সেই সূচনালগ্নে তিনি জিয়াউর রহমানকে তার সঙ্গে যোগ দেয়ার আহ্বান জানান। কিন্তু জিয়া তখন নিজেকে পাকিস্তানি বেতনভুক সেনা উল্লেখ করে সে আহ্বান প্রত্যাখ্যান করেন। উল্লেখ্য যে ২৫ মার্চের অনেক আগেই বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা ও রূপরেখা অনুযায়ী তৎকালীন মেজর শফিউল্লাহ, মেজর খালেদ মোশাররফ ও ক্যাপ্টেন রফিকসহ বহু বাঙালি সেনা অফিসার ও কর্মকর্তা বিদ্রোহ করেন। সে হিসেবে জিয়া ছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে দেরিতে আগত আগন্তুক। আরও গভীর বিশ্লেষণ এটাই বলে যে, জিয়া পাকিস্তানিদের ‘প্ল্যান বি’ অনুযায়ী মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন পকিস্তানের স্বার্থ রক্ষার জন্য। জিয়ার মুক্তিযুদ্ধকালীন কর্মকাণ্ড ও পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে তার সংশ্লিষ্টতা ও ক্ষমতা দখলের পর পাকিস্তানপন্থি ও গণহত্যাকারীদের রাজনীতিতে ফিরিয়ে আনা, সংবিধান সংশোধন করে রাষ্ট্রের চরিত্র বদলে দেয়া, বঙ্গবন্ধুর খুনিদের পুরস্কৃত করা, গণহত্যার বিচার বন্ধ করা ও বিচারাধীন ১৭ হাজার আসামিকে মুক্তি প্রদান, মুক্তিযোদ্ধা সেনা ও অফিসারদের হত্যা করাসহ অসংখ্য কর্মকাণ্ড এই যুক্তিকে সমর্থন করে।
উত্তাল মার্চের গণ-আন্দোলন বেগবান হয়ে এদেশে অবস্থিত পাকিস্তানি সামরিক এস্টাবলিশমেন্টকে কোণঠাসা করে ফেলে। কারণ কারফিউ দিয়ে বা গুলি করেও ক্ষুব্ধ জনতার রোষানল প্রশমিত হওয়ার কোনো আভাস পরিলক্ষিত হচ্ছিল না। সেনাবাহিনীর তরফ থেকে বঙ্গবন্ধুকে স্বাধীনতা ঘোষণা না করার আবেদন জানানো হতে থাকে। একই সঙ্গে ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে প্রস্তুত থাকে পাক সেনাবাহিনী। পাকিস্তানি মেজর সিদ্দিক সালেকের বই থেকে জানা যায় যে, পূর্ব পাকিস্তানের জিওসি বঙ্গবন্ধুকে এ কথা বলেও সতর্ক করে যে, পাকিস্তানের ঐক্যের বিরুদ্ধে কোনো কথা ৭ মার্চের ভাষণে উচ্চারিত হলে এ দেশের সবকিছু মাটিতে এমনভাবে মিশিয়ে দেয়া হবে যে, এখানে শাসন করার বা শাসিত হওয়ার মতো কেউ আর জীবিত থাকবে না। কিন্তু এ গর্জনে বাঙালির নেতা কর্ণপাত করেননি। তাই বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে ৭ মার্চ সুস্পষ্টভাবে উচ্চারিত হয়েছে স্বাধীনতার মন্ত্র, যুদ্ধের মন্ত্র, শত্রুকে প্রতিরোধ করার, ভাতে, পানিতে মারার কৌশল, গ্রামে গ্রামে, পাড়ায়-মহল্লায় প্রতিরোধের দুর্গ ও মুক্তিবাহিনী গড়ে তোলার মন্ত্র। উচ্চারিত হয়েছে পাকিস্তানিদের সঙ্গে সহযোগিতা না করার অহ্বান। উচ্চারিত হয়েছে সেই অমোঘ মৃত্যুঞ্জয়ী বাণী ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ স্বাধীনতায় বিশ্বাসী প্রতিটি বাঙালি সেই ভাষণের অর্থ বুঝতে পেরেছিল এবং সেই নির্দেশানুযায়ী ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে ছিনিয়ে আনে বাংলার স্বাধীনতা।
লেখক: সাহিত্যিক ও অধ্যাপক, কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ