আল্লাহর বিধানেই মানবতার মুক্তি’ নরসিংদী কর্মী সম্মেলনে হেযবুত তওহীদের ইমাম

নরসিংদীতে হেযবুত তওহীদের উদ্যোগে ‘চলমান সংকট নিরসনে তওহীদভিত্তিক আধুনিক রাষ্ট্র গঠনের বিকল্প নেই’ শীর্ষক কর্মী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। গতকাল সোমবার (১৫ সেপ্টেম্বর) সকাল ১০টায় নরসিংদী শিশু একাডেমিতে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে নরসিংদী জেলা হেযবুত তওহীদ।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে বক্তব্য রাখেন হেযবুত তওহীদের শীর্ষ নেতা ইমাম হোসাইন মোহাম্মদ সেলিম। তিনি তার বক্তব্যে প্রচলিত ব্যবস্থার বিপরীতে তওহীদভিত্তিক এক নতুন সভ্যতার রূপরেখা তুলে ধরেন। বর্তমান বিশ্বের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও নৈতিক সংকট থেকে উত্তরণের পথনির্দেশ ফুটে ওঠে তাঁর বক্তব্যে।
হোসাইন মোহাম্মদ সেলিম তার বক্তব্যে বলেন, “আজ আমরা যে মহাসঙ্কটে নিমজ্জিত, তার মূল কারণ একটিই স্রষ্টাকে বাদ দিয়ে মানবসৃষ্ট জীবনব্যবস্থার প্রতি চর্চা। আমরা আল্লাহর সার্বভৌমত্বকে অস্বীকার করে মানুষের তৈরি বিধানকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেছি। এর পরিণাম আজ আমাদের সামনে স্পষ্ট।”
তিনি বাংলাদেশের সংবিধানের উদাহরণ টেনে বলেন, “একটি দেশের সর্বোচ্চ আইন তার সংবিধান। বাংলাদেশের সংবিধান গত অর্ধশতাব্দীতে ১৭ বার সংশোধন করতে হয়েছে। প্রতিটি সংশোধনীই পূর্ববর্তী ব্যবস্থার অসম্পূর্ণতা ও ব্যর্থতার নীরব সাক্ষী। এটিই প্রমাণ করে মানুষের সীমাবদ্ধ জ্ঞান, পক্ষপাতদুষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি এবং পরিবর্তনশীল প্রবৃত্তি দ্বারা রচিত কোনো বিধান কখনো মানবজাতির জন্য স্থায়ী শান্তি ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে পারে না। মানুষের তৈরি আইন আজ আছে, কাল বদলে যায়। এর ফলস্বরূপ আমরা কী দেখছি? অবিচার, দুর্নীতি, হানাহানি আর নিরাপত্তাহীনতার এক অতল গহ্বরে তলিয়ে যাচ্ছে সমাজ। বিচারহীনতার সংস্কৃতি আমাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করেছে, আর দুর্নীতি এক মহীরুহে পরিণত হয়েছে যার ছায়াতলে পিষ্ট হচ্ছে সাধারণ মানুষ। এই ব্যবস্থা আমাদের শান্তি দিতে পারেনি, পারবেও না।”
এই গভীর সংকট থেকে উত্তরণের পথ তুলে ধরে তিনি বলেন, “মুক্তির পথ একটাই। মানবরচিত সমস্ত তন্ত্রমন্ত্র, মতবাদ ও ব্যবস্থা ছুঁড়ে ফেলে নিরঙ্কুশভাবে আল্লাহর হুকুমের কাছে আত্মসমর্পণ করতে হবে। একটি তওহীদভিত্তিক রাষ্ট্র গঠন করতে হবে, যেখানে সার্বভৌমত্ব থাকবে একমাত্র আল্লাহর। যেখানে আইন রচিত হবে মানুষের সীমাবদ্ধ জ্ঞান দিয়ে নয়, বরং সর্বজ্ঞানী স্রষ্টার দেওয়া নিখুঁত জীবনবিধানের আলোকে। আল্লাহর বিধানেই রয়েছে মানবতার প্রকৃত মুক্তি।”
“এই পথ কোনো সহজ পথ নয়। এই আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য আল্লাহ মোমেনদের জীবন ও সম্পদ উৎসর্গ করতে বলেছেন। এটি কোনো শ্লোগানসর্বস্ব পরিবর্তন নয়, এটি এক আত্মিক ও বাস্তবিক বিপ্লব। নিজেদের সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়ে আল্লাহর জমিনে তাঁর দীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে হবে।” -যোগ করেন তিনি।
মুসলিম বিশ্বের অনৈক্যের দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, “আজ মুসলিম উম্মাহ শত শত ফেরকা আর মাজহাবের নামে বিভক্ত। আমরা একে অপরকে শত্রু জ্ঞান করছি, একে অপরের বিরুদ্ধে ফতোয়া দিচ্ছি, এমনকি একে অপরের রক্ত ঝরাচ্ছি। এই আত্মঘাতী বিভেদই আমাদের প্রধান দুর্বলতা। শত্রুরা আমাদের এই বিভেদের সুযোগ নিচ্ছে।”
ঐক্যের ভিত্তি কী হবে তা স্পষ্টভাবে তুলে ধরে তিনি বলেন, “আমাদের ঐক্যের মূল ভিত্তি হবে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’। এই ঘোষণার অর্থ শুধু ‘আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই’ নয়, এর প্রকৃত অর্থ হলো ‘আল্লাহ ছাড়া কোনো হুকুমদাতা, বিধানদাতা ও সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক নেই’। যখন আমরা জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে এই সত্যকে মেনে নেব, তখনই আমাদের মধ্যেকার সমস্ত বিভেদের প্রাচীর ভেঙে পড়বে। তখন আমরা এক কালেমার পতাকাতলে এক অজেয় জাতিতে পরিণত হব।”
তিনি উপস্থিত হেযবুত তওহীদের কর্মীদের তাদের ঐতিহাসিক দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেন। তিনি বলেন, “আপনারা নিজেদেরকে কেবল একটি সংগঠনের কর্মী ভাববেন না। আপনারা হলেন এক নতুন সভ্যতার অগ্রদূত। যে সভ্যতা নির্মিত হবে আল্লাহর হুকুমের উপর ভিত্তি করে যার ফল হবে ন্যায়, সাম্য, সুবিচার, শান্তি ও মানবতা। কিন্তু এই মহান দায়িত্ব পালনের জন্য প্রথমে নিজেদের প্রস্তুত করতে হবে। ইসলামের বাস্তবিক শিক্ষা, যা শুধু উপাসনালয়ে সীমাবদ্ধ নয়, বরং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, তা নিজেদের জীবনে ধারণ করতে হবে। আপনাদের চরিত্র, আপনাদের কর্ম এবং আপনাদের পারস্পরিক আচরণই হবে ইসলামের বিজ্ঞাপন।”
তিনি কর্মীদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, “আপনাদের দায়িত্ব হলো ইসলামের এই প্রকৃত শিক্ষার মশাল হাতে নিয়ে সমাজের প্রতিটি ঘরে ঘরে পৌঁছে যাওয়া। মানুষকে বোঝানো যে, ধর্ম কোনো বিভেদের নাম নয়, ধর্মই হলো ঐক্যের মূল ভিত্তি। এই সত্যের বাণী যখন দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়বে, তখন এক নতুন জাগরণ সৃষ্টি হবে, ইনশাল্লাহ।”
নরসিংদী জেলার সাংগঠনিক সম্পাদক মো. গোলজার হোসাইনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন হেযবুত তওহীদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও নারী বিভাগের প্রধান রুফায়দাহ পন্নী, ঢাকা বিভাগীয় সভাপতি মাহবুব আলম মাহফুজ, নরসিংদী জেলা সভাপতি ফারুক মিয়া, নরসিংদী রিপোটার্স ক্লাবের সভাপতি শফিকুল ইসলাম রিপন হেযবুত তওহীদের নারী ও শিশু স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক সুলতানা রাজিয়া, নারী বিষয়ক সহকারী সম্পাদক আয়েশা সিদ্দিকা, নারায়ণগঞ্জ অঞ্চলের আমির আরিফ উদ্দিন প্রমুখ।
বক্তারা তাদের বক্তব্যে সমাজে সাম্য, ন্যায় ও মানবতার ভিত্তিতে একটি তওহীদভিত্তিক রাষ্ট্র গঠনের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। বর্তমান সমাজে যে অস্থিরতা ও বিভ্রান্তি বিরাজ করছে তা দূর করতে হলে আল্লাহর হুকুমের উপর ভিত্তি করে একটি ঐক্যবদ্ধ জাতি গঠনের আহ্বান জানান তারা। অনুষ্ঠানে উপস্থিত হাজারো কর্মীরা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে নিজেদের জীবন সম্পদ উৎসর্গ করে নিবেদিত প্রাণ হয়ে কাজ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।
কর্মী সম্মেলন ঘিরে সকাল ৯টা থেকেই জেলার বিভিন্ন উপজেলা থেকে কর্মী-সমর্থকরা আসতে থাকে অনুষ্ঠানস্থলে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই হাজারো নেতাকর্মীর আগমনে অনুষ্ঠানস্থল কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়।
হেযবুত তওহীদ ছাত্র ফোরামের সদস্য জিন্নাত আক্তারের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে পবিত্র কোরআন থেকে তেলাওয়াত করেন গাজী শাহীদুল হাসান আইয়ুবী। এরপর দলীয় সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে সম্মেলনের মূল পর্বের সূচনা করা হয়।
এরপর অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন। অনুষ্ঠানে অর্ধশতাধিক মানুষ হেযবুত তওহীদের আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে ঐকমত্য পোষণ করে আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করার জন্য অঙ্গীকারাবদ্ধ হন। সবশেষে সমাপণী বক্তব্যের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি হয়। দিনব্যাপী এই সম্মেলনে নেতাকর্মীদের উপস্থিতি ও উদ্দীপনা ছিল চোখে পড়ার মতো।